Friday, 22 March 2013

একটি ভালোলাগার মত বই

হুমায়ূণ আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ পড়লাম। অসাধারণ লেখা। মুঘল বাদশা হুমায়ূণের অদ্ভুত জীবনের কয়েকটা পাতা। শুধুমাত্র লেখার গুণেই একটানে শেষ হয়ে যায়। পড়ে মন ভরে গেল। কোন কোন মানুষের সম্পর্কে আমরা কত কম জানি!! বাদশা হুমায়ূণ কে বরাবর রাজ্যহারা সম্রাট হিসেবে একটু করুণার চোখেই দেখে এসেছি। কিন্তু বই টা পড়ে মনে হল মানুষ হিসেবে তিনি পান্ডিত্য মানবিকতা আর হৃদয়বোধের যে উচ্চতায় উঠেছিলেন একমাত্র সঠিক অর্থে যিনি শাহেনশা তাঁর জন্যই সেই জায়গা টা নির্দিষ্ট থাকে। মহাবীর শের শাহ ও তাঁর নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল। প্রতিদ্বন্দী হুমায়ূণের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা তাঁকে আর বেশী শ্রদ্ধেয় করে তোলে। এক জায়গায় শের শাহ সম্রাট হুমায়ূণের লেখা একটি অপূর্ব কবিতা পাঠ করছেন – 

           “অশ্ব অশ্বারোহীর বন্ধু নয়।
           যেমন বন্ধু নয় বায়ু, মেঘমালার।
           বন্ধু হবে এমন যাদের সাথে কখনো দেখা হবেনা।
           দু’জনেই থাকবে দুজনের কাছে অদৃশ্য।
           দৃশ্যমান থাকবে তাদের ভালোবাসা।”    

সারা বই জুড়ে ছড়ানো আছে মণিমুক্তোর মত একাধিক কবিতা। বেশীরভাগ ই বাদশাহ হুমায়ূণের লেখা। কয়েকটা এত ভাল লাগলো - 

“আমরা বাস করি সুন্দরের মধ্যে
সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর।
যেমন পুণ্যের চারদিকে থাকে
পাপের শক্ত খোলস। ভাগ্যবান সেইজন যে অসুন্দরের পর্দা ছিঁড়ে
সুন্দর দেখে। পুণ্যের কাছে যায় পাপের
শক্ত খোলস ভেঙে।”  
 
“পৃথিবীতে নিজের খুশিমতো আসি নি, খুশিমতো চলেও
যাব না। জীবন হাত ধরে নিয়ে এসেছিল বলেই এসেছি।
মৃত্যু হাত ধরে নিয়ে চলে যাবে, তখন চলে যাব।”  

আর আছে কোহিনূরের প্রথম দিক কার ইতিহাস। পায়রার ডিমের চেয়েও বড় এক খন্ড পাথর যার উপর আলো পড়লে আগুনের মত জ্বলে ওঠে। যা বিক্রী হয়না, যা শুধুমাত্র তরোয়ালের জোরে কেড়ে নেওয়া যায় অথবা ভালোবাসার উপহার হিসেবে পাওয়া যায়।
আর এক জায়গায় বাদশা হুমায়ূণের বিদ্রোহী ভাই কামরান মির্জা বলছেন –

“রাজ্য হলো এমন এক রূপবতী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারীর প্রয়োজন হয়”

হয়তো কথা টা ঠিক। হয়তো এই বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কোনটাই তাঁর মত বড় মাপের মানুষের উপযুক্ত ছিলনা। এই চিরাচরিত রক্তক্ষয়, ষড়যন্ত্র, কুটিলতা, বিশ্বাসঘাতকতার জগতে বাস করেও অন্য এক অনিন্দ্যসুন্দর জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন – সেই জগৎ যাকে তরবারী দিয়ে জয় করা যায়না, রাজনীতি দিয়ে অধিকার করা যায়না, একমাত্র আধ্যাত্মিক বোধেই যা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে । আর তাই বোধহয় এই বাদশাহের মৃত্যু হয়েছিল আর পাঁচজন তথাকথিত বীরচক্রধারীর মত তরবারীর আঘাতে নয়, তাঁর অতি প্রিয় গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে। 

(Reference: বাদশাহ নামদার, হুমায়ূণ আহমেদ, অন্যপ্রকাশ)

No comments:

Post a Comment