সোমবার
সন্ধ্যেবেলায় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নিত্যনৈমিত্তিক চা খাচ্ছি, অমরেশ প্রথম চুমুক
টা দিয়েই বললো “দি আইডিয়া – আজ রাতে বিরিয়ানী রান্না করবো।” আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম।
বিরিয়ানী!!! বিরিয়ানী??? বাড়ীতে??? সে তো সিরাজ কি আরসালানে গিয়ে খেতে হয়। মানে পাড়ার
রেস্তোরাতেও খায় ঠিক ই, কিন্তু বিরিয়ানী বললেই কেমন পার্ক সার্কাসের দোকান গুলোর কথা
মনে পড়ে না? সেই হাত-টাত ধুয়ে চেয়ার এ গুছিয়ে বসলাম, প্রথমেই বেশী না, এই একটু করে
কাবাব খেয়ে নিলুম, সেই অমৃতের পরেই দু নম্বরে যার নাম লিস্টি তে আছে। তারপর এল সাদা
সাদা প্লেটে ঢিপি করা হলুদ-খয়েরী লম্বা লম্বা ভাতের দানা মণিমুক্তার মত ছড়িয়ে, মাঝখান
থেকে রাজসিক মাংসের টুকরো অবহেলায় তাকিয়ে আছে, এদিকে একখান সেদ্ধ ডিম ওদিকে আরেকখান
সোনালী আলু নিজ গরবে গরবিনী, সুগন্ধে প্রাণ আনচান – ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং না ঘন্টা – গন্ধ শুঁকে মনে হচ্ছে এই যেন আমরণ অনশন ভেঙ্গে উঠে
এলুম। আর বলাবাহুল্য এরপর খেতে হবে মাটির রেকাবি তে এক কপি ফিরনী। ব্যাস - হাতে গোলাপফুল
ধরা মোগল বাদশা’র মেজাজের সাথে আর নিজের টার কোন তফাত থাকবেনা। যাকগে সেসব কথা – কিন্তু
মানে সেই বিরিয়ানী হবে আমাদের বাড়ীতে ? ভাবা যায়!!! বিরিয়ানী মশলা প্যাকেট করে পাওয়া
যায় জানি – তুকাই এর বৌ, ও পাড়ার রাণুকাকিমা এরা শুনেছি তাই দিয়ে বাড়ীতে বিরিয়ানী করে লোকসমাজে সুপারহিট হয়েছেন। ও আচ্ছা – তাই বল।
“ঘোষ ব্রাদার্সে বিরিয়ানী মশলা পাওয়া যাবে নিশ্চয়” – আমি বিজ্ঞের মত বললাম।
“বিরিয়ানী
মশলা!!! ওসব গুপি জিনিষ না। করতে হলে এক্কেবারে আসল মশলা দিয়ে করবো। খাবার-দাবার নিয়ে
কোনরক্ম দুনম্বরী তে আমি নেই – বুঝলি?”
আমি
একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়লাম। অমরেশ বলেই চললো “এই যে সেদিন শেয়ালদা থেকে শাহ জিরা, শাহ
মরিচ হ্যানাত্যানা কেওরা জল, গোলাপ জল এসব কিনে আনলাম – সেটা কিসের জন্য, হ্যাঁ? জামা
তে ছিটোবার জন্য?”
“না
মানে তা নিশ্চয় নয়। কিন্তু – মানে – শুনেছি সেসব মশলা সাদা ন্যাকরায় সেদ্ধ করে তাপ্পর
তার এক্সট্র্যাক্ট দিয়ে – আবার নাকি হাঁড়ীর মুখ আটা দিয়ে সেলাই করে দিতে হয় - মানে
সেসব করা তো রাজা-গজা দের ব্যাপার – আমরা ছেলেমানুষ -”
“দরকার
হলে আমরাও করবো”
নিরুপায়
হয়ে শেষ চেষ্টা দিলুম – “ বলছি একটা রেসিপী ও তো দরকার – সেটাও কি – মানে – এখন নিশ্চয়
তুকাই এর বৌ কে ফোন করে জিজ্ঞেশ করবো না।”
“আহা
– তা কেন? ইন্টারনেট বলেও তো একটা বস্তু আছে, না কি? সেখানে তো বাঁশবেড়িয়া তে কটা বাঁদর
আছে তার ও হিসেব দেয়, আর সামান্য বিরিয়ানীর রেসিপী পাওয়া যাবে না? সারাদিন ঐ ফেসবুক
ই কর, নেট টা কে তো আর অন্য কাজে লাগাতে জানলি না।”
এই তো
– সুযোগ পেয়েই আমায় ঠুকে দেওয়া হল। একটু ফেসবুক করি বলে লোকজন এমন করে না, ভাবা যায়না!!!
যাকগে – কি বলবো আর দুঃখের কথা।
বাস
এ উঠতে উঠতে হিসেব হল – বিরিয়ানী রান্না করতে কি কি লাগে আর আমাদের গোডাউনে মানে ফ্রীজে
কি কি আছে। প্রথমেই লাগবে চিকেন – আছে?
না নেই।
আলু?
আছে?
ডিম?
আছে
বোধহয়।
ঠিক
করে বল।
হ্যাঁ
হ্যাঁ আছে।
বাসমতী
চাল?
প্রচুর।
পেঁয়াজ
রসুন আদা?
সবসময়
ই থাকে।
অতঃপর
বাস থেকে নেমে চিকেন কিনতে যাওয়া হল। তারপর কোথাও কিছু নেই, চিকেন আমার হাতে ঝুলিয়ে
দিয়ে বাবু সিগারেট কিনতে হারিয়ে গেলেন। এদিকে আমার তো বিখ্যাত কুকুরের ভয়। প্রাণ মুরগীর
থলি তে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সব আশেপাশের কুকুর রা গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে আর সন্দেহজনক ভাবে
তাকাচ্ছে। ভূতে তাড়া করলে রাম নাম নিতে হয় জানি, এদিকে কুকুর তাড়া করলে ছুটতে হয়না
এইটুকুই শুধু শুনেছি, কার নাম নেবো তা তো বুঝতে পারছিনা। অবস্থা যখন অতিশয় সঙ্গীন,
মুরগীর থলি আর বোধ হয় শেষরক্ষা হলোনা – অমরেশ নির্বিকার ভাবে এসে দাঁড়ালো। আমিও বাবা
মাল গছিয়ে দিয়ে নিরাপদ হলুম। কি আশ্চর্যি – কুকুর গুলো এই বেলা বেমালুম সরে পড়লো। অমরেশ
বললো “এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? তোকে দেখেই বুঝেছে ক্যাবলা টাইপ, একটু ভয় দেখালেই
কেল্লা ফতে। আসলে ওরাও বোঝে। সবাই তো আর আমার মত ওস্তাদ হয়না। কি আর করা যাবে – দুঃখ
পাসনা।”
নিঃশব্দে
অপমান হজম করলুম। সবারই সময় আসে। মেরা নম্বর ভী আয়েগা। আমি চুপ মেরে গেলুম। এমন কি
অমরেশ যখন ভাব করার জন্য গায়ে পড়ে ফুচকা খাওয়ার প্রস্তাব করলো তখন ও চুপ করে থাকলাম
– তাই বলে ফুচকা টা যে খেলাম না তা নয়। এরপর আবার চা খাওয়ার কথা উঠলো – কে না জানে
চা কে কখনো না বলতে নেই, চা হল লক্ষী। চা এর সঙ্গে আমার প্রিয় লেড়ো বিস্কুট ও ছাড়লাম
না। যাইহোক মোটমাট এসব খেয়েদেয়ে যখন বাড়ী ঢুকলাম তখন বাজে ৭ টা।
যথাবিধ
আয়োজন করে গুপিযন্ত্র খোলা হল। তাপ্পর ওম গুগলায়ে নমঃ। সে বিভিন্ন রকম বিরিয়ানীর রেসিপী
ঝপাঝপ নামতে লাগলো। টমাটো দিয়ে বিরিয়ানী, পুদিনাপাতা দিয়ে বিরিয়ানী, পাঁচফোড়ণ দিয়ে
বিরিয়ানী মায় ম্যাগী দিয়ে বিরিয়ানী!!! আমি তো অতি শোকে পাথর। লখনৌ বিরিয়ানী, হায়দ্রাবাদী
বিরিয়ানী এসব অতি উচ্চ মার্গের সাধনাও সব ছিল কিন্তু তাতে কি জানি সব দিতে বলেছে –
আমাদের তুচ্ছ জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। মানে আসল কথা হল সেসব মশলাপাতি আমাদের নেই, কোনদিন
ছিল ও না, হবে ও কিনা হলপ করে বলতে পারছিনা।
আমি বললাম “তাহলে – মানে আজকে বরং রুটী-বাঁধাকপি
খেয়েই চালিয়ে দি, পরে নাহয় অন্য কোনদিন -”
“এত
সহজে ভেঙ্গে পরছিস!!! তোদের না কোন টেনাসিটি নেই, এইজন্য ই কিছু হলনা – ওই রুটি-বাঁধাকপি
খেয়েই সারাজীবন থাকতে হবে তোদের। ভালমন্দ খেতে গেলে না একটু কষ্ট করতে হয়।”
এরপর
আমি আর কিছুই বলবো না।কারণ আর কিছুই বলার থাকে না।
অবশেষে
মনের মত রেসিপী যখন আবিস্কার হল, তখন সারা বাংলায় ভুবনবিখ্যাত সিরিয়াল ‘মা’ সবে শুরু
হয়েছে মানে এই সোয়া ৮ টা বাজে আর কি। যে ভদ্রলোক রেসিপি টি পোস্ট করেছেন, তিনি তাঁর
নিজের হাতে তৈরী বিরিয়ানীর একটি জবরদস্ত ছবিও দিয়েছেন। দেখেই একেবারে ‘এই তো এটাই খুঁজছি’
বলে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। বললে হবেনা – ভদ্রলোক চাকরী করেন, রান্নার হাত চমৎকার, ফটো তোলেন
আবার এনফীল্ড ও চালান। আর রেসিপীটাও কি দুর্দান্ত লিখেছেন, এক্কেবারে
algorithm স্টাইলে। আমি আর অমরেশ তো ঝপাঝপ
তাঁর ফ্যান হয়ে গেলুম।
জানা
গেল এরে কই হান্ডী বিরিয়ানী। অতএব একখান বিশাল মাপের হান্ডী দরকার। অত বড় হাঁড়ী কি
আমাদের আছে? আমি একে ছেলেমানুষ, তাই নিরীহ গোছের, আমি কি করে জানবো ঐ অতিকায় হাঁড়ী
আমাদের আছে কি নেই। মা কে গিয়ে ধরলাম। মা যা তথ্যাদি দিলেন তার থেকে বোঝা গেল – আছে
বটে এরকম একখান হাঁড়ী, তিনি তাঁর শাশুড়ীর থেকে পেয়েছিলেন, কিন্তু সে রান্নাঘরের কোন
গভীর অন্ধকারে সেঁধানো আছে খুঁজে দেখতে হবে। অনেক টানাহ্যাঁচরার পর হাঁড়ী বেরোলো, হাঁড়ীর
মধ্যে থেকে বেরোলো আরো সব মেজ সেজ ছোট বাটি ঘটি টিপিনবাক্স, খানিকটা ঝুল কালি-মালি
কিসব। রাত ৯ টার সময় মা হাঁড়ী মেজে ঘষে ধুয়ে চকচকে করে তার চেহারা ফিরালেন। ইতিমধ্যে
মাংস ধোয়া হচ্ছে। বিরিয়ানীতে দেওয়া হবে বলে বড় বড় পীস কাটানো হয়েছে। সেগুলো ধুতে এবার
ল্যাজে-গোবরে অবস্থা।
এদিকে
আমি হিসেব কষছি মাংস ম্যারিনেট করে রাখতে বলেছে আড়াই ঘন্টা। এদিকে তার আগে পেঁয়াজ-রসুন-আদা
বাটতে লাগবে আধঘন্টা। রান্না করতে লাগবে আরো এক ঘন্টা। একুনে চার ঘন্টা। তাহলে কি শেষে
আমরা রাত দেড় টার সময় ডিনার করবো? এই মর্মান্তিক ঠান্ডায়? তারপরেও বেঁচে থাকবো? কি
জানি বাবা – ভগবান ই ভরসা।